।।বিকে রিপোর্ট।।
রাঙামাটির সাজেক ভ্যালিতে লাগা আগুন সাড়ে চার ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে এসেও ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে ছাই হয়ে গেছে ৯৪টি রিসোর্ট-কটেজ ও বসতঘর। রাঙামাটির সাজেকে আগুনের ঘটনায় প্রায় ১০০ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতির দাবি করেছেন সাজেক কটেজ-রিসোর্ট মালিক সমিতি।
সমিতির হিসাবে সাজেকের আগুনে ৩৪টি রিসোর্ট, সাতটি রেস্টুরেন্ট, ১৮টি দোকান ও ৩৬টি স্থানীয়দের বসতঘর পুড়ে গেছে। বর্তমানে সাজেকে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
অগ্নিকাণ্ডের পর রুইলুইপাড়া স্টোন গার্ডেনে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছেন স্থানীয় লুসাই ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষ।
উল্লেখ্য, গত সোমবার বেলা পৌনে একটার দিকে বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের রুইলুই পর্যটনকেন্দ্রে আগুন লাগার এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় লোকজন ও সাজেক রিসোর্ট-কটেজ মালিক সমিতি সূত্র জানায়, আজ দুপুরে রুইলুইপাড়ার হেডম্যান (মৌজাপ্রধান) লাল থাংয়া লুসাইয়ের বাসভবনের পাশে সাজেক ইকো ভ্যালি নামের একটি রিসোর্টে আগুন লাগে। পরে তা আশপাশের বসতঘর ও রিসোর্ট-কটেজে ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ রূপ নেয়। এ সময় আতঙ্কিত কয়েক শ পর্যটক রিসোর্ট-কটেজ থেকে বেরিয়ে ছোটাছুটি শুরু করেন।
সাজেকে ফায়ার সার্ভিসের কোনো স্টেশন নেই। আগুন লাগার তিন ঘণ্টা পর বিকেল চারটার দিকে খাগড়াছড়ি সদর, দীঘিনালা ও পানছড়ি উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা পর বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। সিগারেট ও বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
রিসোর্ট-কটেজ মালিক সমিতি জানায়, ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে ৩২টি রিসোর্ট ও কটেজ, ৩৬টি বসতঘর, ৬টি রেস্তোরাঁ ও ২০টি দোকান সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। এদিকে জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, আগুনে অন্তত ১৪০টি রিসোর্ট-কটেজ ও বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে বাঘাইহাট সেনা জোনের জোন অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. খায়রুল আমিন, বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিরিন আক্তার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। অগ্নিকাণ্ডের পর কিছু সময়ের জন্য পর্যটকদের সাজেকে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে স্থানীয় প্রশাসন।
আগুনে লুসাই জনগোষ্ঠীর ১৬টি ও স্থানীয় ত্রিপুরাদের ২০টি বসতঘর পুড়ে যায়। এদিকে আগুনের পর পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে গত সোমবার রাতে পর্যটক ভ্রমণে প্রশাসন নিরুৎসাহ করলেও ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল মঙ্গলবার সেটা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনা তদন্ত এবং ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে জেলা প্রশাসন পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
কটেজ-রিসোর্ট মালিক সমিতির নেতারা জানান, সাজেক ইকো ভ্যালি রিসোর্টে ইলেকট্রিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত।
এরপর অবকাশ, মেঘছুট মারুয়াটি রেস্টুরেন্ট, মনটানা রেস্টুরেন্ট, চিলেকোঠা রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে মোট ৯৫টি রিসোর্ট, দোকান, রেস্টুরেন্ট ও বসতঘর পুড়ে গেছে। সেনাবাহিনী, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস, স্থানীয় বাসিন্দা, রিসোর্ট মালিক ও স্টাফ এবং ট্যুরিস্টদের সার্বিক প্রচেষ্টায় রাত ২টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
এদিকে সাজেকে ভ্যালির বর্তমানে যে অংশে আগুনে লেগেছে, হঠাৎ দেখলেই মনে হবে যেন এটি যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনো নগরী। মঙ্গলবার সকাল থেকে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুনের বাকি অংশ নেভানোর কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
বিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট লাইন সচলে কাজ করছেন বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেটের কর্মীরা। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে রাতে ক্ষতিগ্রস্তদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। এত বড় ক্ষতি কিভাবে সামাল দেবে সেই চিন্তা সবার চোখে-মুখে।
সাজেক কটেজ ও রিসোর্ট মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক রাহুল চাকমা জন বলেন, ‘অনেকেই লেখালেখি করছেন, এখানে নাশকতা থাকতে পারে কি না, কিন্তু আমরা জানি এখানে কোনো নাশকতা ঘটেনি। এটা একটা দুর্ঘটনা।
নাশকতার কোনো হুমকি নেই। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সেনাবাহিনী, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস, স্থানীয়রা অনেক পরিশ্রম করেছে। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে।’
মর্নিং স্টার রিসোর্ট, নীল পাহাড় রিসোর্ট ও চিলোকোঠা রেস্টুরেন্টের মালিক আলবার্ট লুসাই। রিসোর্ট সংলগ্ন ছিল তাঁর বসতঘর এবং একটি মোটরসাইকেলের গ্যারেজ। সেই আলবার্ট সব হারিয়ে সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছেন পার্শ্ববর্তী গির্জায়। সেখানে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, একটি অগ্নিকাণ্ডে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছি পুরো পরিবার। গ্যারেজে থাকা ছয়টি মোটরসাইকেলও পুড়ে গেছে। এত দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল যে বাড়ির কিছুই রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। আমার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ চার কোটি টাকারও বেশি।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ বলেন, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।