যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে উত্তপ্ত বৈঠকের পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের ভলোদিমির জেলেনস্কির উপস্থিতিতে ইউক্রেন সংকট নিয়ে যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে সম্মেলন শুরু হয়।
ইউক্রেন সংকট নিয়ে যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে চারটি পদক্ষেপের বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে।
রবিবার ২ মার্চ লন্ডনের ল্যাংকেস্টার হাউসে সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। চারটি পদক্ষেপই ইউক্রেনের পক্ষে নেওয়া হয়েছে।
কিয়ার স্টারমারের আহ্বানে লন্ডনে শুরু হওয়া শীর্ষ সম্মেলনে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের এক ডজনেরও বেশি ইউরোপীয় নেতা অংশ নিয়েছেন। সম্মেলনের আয়োজক যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার জেলেনস্কিকে পাশে নিয়ে রবিবার সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। এ সময় ইউক্রেন ও ইউরোপীয় দেশগুলোর পতাকা সামনে রেখে তিনি বলেন, ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য এক প্রজন্মের একটি মুহূর্ত এটি।
সংবাদ সম্মেলনে কিয়ার স্টারমার বলেন, ইউক্রেনকে সহায়তার জন্য নতুন যেকোনো চুক্তি অবশ্যই জোরালো হতে হবে। আর সব দেশকে নিজেদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা অনুযায়ী ভূমিকা রাখতে হবে। তাদের দায়িত্ব নিতে হবে এবং নিজেদের দায়িত্ব বাড়াতে হবে।
স্টারমারের ভাষ্য অনুযায়ী, সম্মেলনে ঐকমত্য হওয়ার চারটি পদক্ষেপ হলো—যুদ্ধ চলাকালে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে এবং রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি করতে হবে; স্থায়ী শান্তির ক্ষেত্রে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং যেকোনো শান্তি আলোচনার টেবিলে ইউক্রেনকে অবশ্যই রাখতে হবে; শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ ঠেকানোর লক্ষ্যে কাজ করতে হবে ইউরোপের নেতাদের; ইউক্রেনের সুরক্ষার জন্য একটি জোট গঠন করতে হবে এবং দেশটিতে শান্তি নিশ্চিত করতে হবে।
এর পাশাপাশি রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য ইউক্রেনকে ১৬০ কোটি পাউন্ড দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন কিয়ার স্টারমার। যুক্তরাজ্যের দেওয়া এই অর্থ খরচ করে ইউক্রেনের জন্য পাঁচ হাজারের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র কেনা হবে। ওই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহার করা হবে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে তিনি বলেন, আমি আশা করছি, আপনি জানেন আমরা যত সময় লাগুক না কেন, আমরা আপনার ও ইউক্রেনের জনগণের সঙ্গে রয়েছি। এই টেবিলের চারপাশের প্রত্যেকে আপনার পাশে আছে।
আমাদের সকলের সুবিধায় শান্তির জন্য এই বৈঠক থেকে যেসব পদক্ষেপ আসবে, সেই বিষয়ে আমাদের ঐক্যমতে পৌঁছাতে হবে।
উল্লেখ্য, তিন বছরের বেশি সময় ধরে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা চলছে। এই সংকট সমাধানের উদ্দেশে সম্মেলন শুরুর আগে কিয়ার স্টারমার বিভিন্ন দেশের নেতাদের একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, হোয়াইট হাউসে শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জেলেনস্কির মধ্যে যে ঘটনা ঘটেছে, তা কেউ দেখতে চায় না।
গণমাধ্যমকে স্টারমার বলেন, আমরা তিন বছর ধরে চলমান একটি সংঘাতের মধ্যে রয়েছি। এখন আমাদের দীর্ঘমেয়াদি শান্তির দিকে এগোতে হবে। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ফ্রান্স এবং সম্ভবত আরও এক–দুটি দেশকে সঙ্গে নিয়ে ইউক্রেনের সঙ্গে কাজ করবে যুক্তরাজ্য। পরে ওই পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনিও একই সুরে কথা বলেন।
লন্ডনের সম্মেলনে ফ্রান্স ও ইতালি ছাড়াও জার্মানি, ডেনমার্ক, তুরস্ক, রোমানিয়া, ফিনল্যান্ড ও পোল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নেতারা অংশ নিয়েছেন। সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর প্রধান মার্ক রুটে ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও। সম্মেলনের আগে মার্ক রুটে বলেন, এই জোটকে শক্তিশালী করার জন্য ইউরোপ তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াবে। ইউরোপের দেশগুলোকে আরও অর্থ দিতে হবে।
এর আগে গতকাল শনিবার যুক্তরাজ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্টারমার, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটেসহ ইউরোপের আরও ১৮ শীর্ষ নেতা লন্ডনে জেলেনস্কিকে স্বাগত জানান। এদিন বিকেলেই দুজন একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন।
বৈঠকের আগে স্টারমার বলেন, যতদিন প্রয়োজন হবে ইউক্রেনের পাশে থাকবে যুক্তরাজ্যে।
জবাবে জেলেনস্কি বলেন, যুক্তরাজ্যের মতো বন্ধু পেয়ে তিনি গর্বিত। আজ রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে দেখা করার কথা রয়েছে জেলেনস্কির।
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি বলেছে, ওভাল অফিসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে শুক্রবারের জেলেনস্কির উত্তপ্ত বৈঠকের একেবারেই বিপরীত দৃশ্য দেখা গেছে লন্ডনে।
ওভাল অফিসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্সের সঙ্গে জেলেনস্কির উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর আকস্মিক বৈঠকস্থল ত্যাগের পর ইউরোপে পৌঁছেছেন জেলেনস্কি। সেখানে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নেতারা ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে শান্তি পরিকল্পনা করছেন বলে জানিয়েছেন।
সম্মেলনে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি বলেছেন, ইউক্রেনকে ঘিরে ‘‘পশ্চিমা বিশ্বে বিভাজন’’ এড়াতে এই সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্টারমার বলেন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং সম্ভবত আরও এক বা দুটি পক্ষ যুদ্ধ বন্ধ করার পরিকল্পনায় ইউক্রেনের সঙ্গে কাজ করবে। তারপর আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সেই পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করব।
প্রসংগত, গত শুক্রবার হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প ও জেলেনস্কির বিতণ্ডার পরই লন্ডনে ইউরোপীয় নেতাদের এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শুক্রবারের বৈঠকে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আলোচনার সময় দুজনের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। এরপর হোয়াইট হাউস ত্যাগ করেন জেলেনস্কি। বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে একটি খনিজ সম্পদ চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।